সমাজমাধ্যমের উপর মানুষের নির্ভরশীলতা যেমন বেড়েছে, সেই সঙ্গে জালিয়াতির হারও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। অনলাইন প্রতারণার গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম হল হোয়াট্সঅ্যাপ। সেই অ্যাপটিকে হাতিয়ার করেই আর্থিক প্রতারণার নানা রকমের ছক কষছে জালিয়াতেরা।
তবে শুধু অনলাইন নয়, অফলাইনেও জালিয়াতি চলছে দেদার। সেই জালিয়াতির পন্থা এবং রকমভেদও অনেক। তবে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে সম্প্রতি জালিয়াতির এমন এক উদাহরণ প্রকাশ্যে এসেছে, যা সারা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, এটা হতে পারে?
জালিয়াতির কেন্দ্রবিন্দু উত্তরপ্রদেশের আগরা জেলার একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। সেই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের রেকর্ড হাতড়়ে জানা গিয়েছে, মাত্র ৩০ মাসের মধ্যে ২৫ বার ‘সন্তান প্রসব’ করেছেন এক মহিলা। শুধু তা-ই নয়, ওই সময়ের মধ্যে পাঁচ বার বন্ধ্যাত্বকরণও ‘করিয়েছেন’ তিনি।
অবাক হলেও আগরার ওই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নথি ঘেঁটে তেমনটাই জানা গিয়েছে। এর পরেই বিষয়টি নিয়ে হইচই পড়ে। তদন্তে নামেন সরকারি আধিকারিকেরা।
তদন্তে উঠে আসে যে, মাতৃস্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ সরকারি টাকা হাতানোর জন্যই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভুয়ো নথি জমা দিয়েছিলেন ওই মহিলা। সংবাদমাধ্যম ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’র প্রতিবেদনে সেই ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জালিয়াতির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা ওই মহিলার নাম কৃষ্ণা কুমারী। নাগলা কদম গ্রামের বাসিন্দা তিনি। মজার বিষয় হল, তাঁকে ধরতে গিয়ে অবাক হয়ে যায় পুলিশ।
তদন্ত করে দেখা যায়, কৃষ্ণা কুমারীর নামে যে জালিয়াতি হচ্ছে, তা নিয়ে বিন্দুবিসর্গ ধারণা নেই তাঁর। আসলে তাঁর পরিচয়পত্র ব্যবহার করে চলছিল দুর্নীতি।
সম্প্রতি এক অডিটে জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন (ন্যাশনাল হেল্থ মিশন)-এর প্রকল্প, বিশেষ করে জননী সুরক্ষা যোজনা এবং মহিলা বন্ধ্যাত্বকরণ প্রণোদনা প্রকল্পের অধীনে অনিয়ম দেখার পর জালিয়াতির বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
সরকারি ওই যোজনার আওতায় সন্তান জন্ম দেওয়া এবং বন্ধ্যাত্বকরণ করানোর জন্য আর্থিক সহায়তা করে সরকার। আর সেই টাকা হাতাতেই কৃষ্ণার পরিচয়পত্র ব্যবহার করা হচ্ছিল বলে খবর।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভুয়ো নথি ব্যবহার করে প্রথমে কৃষ্ণার নামে একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল। সেই অ্যাকাউন্টেই জমা পড়ত সরকারি প্রকল্প থেকে পাওয়া টাকা। তার থেকে ৪৫,০০০ টাকারও বেশি টাকা তুলে নিয়েছিল জালিয়াতেরা।
এর পরেই ঘটনাটি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শুরু করেন কর্তৃপক্ষ। তদন্ত চালিয়ে পাঁচ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে চার জন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারী এবং এক জন কৃষ্ণার গ্রামের এক যুবক। তাঁদের মধ্যে তিন জনকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে।
এফআইআরে যাঁদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন গৌরব থাপা (ব্লক প্রোগ্রাম ম্যানেজার), নীরজ অবস্থি (ব্লক অ্যাকাউন্টিং ম্যানেজার), গৌতম সিংহ (ডেটা এন্ট্রি অপারেটর), আজহার আহমদ (ডেটা এন্ট্রি অপারেটর) এবং অশোক কুমার (কৃষ্ণার গ্রামের বাসিন্দা)।
এর মধ্যে অশোকই কৃষ্ণার নামের ভুয়ো অ্যাকাউন্ট খুলতে সাহায্য করেছিলেন বলে অভিযোগ। আগরার প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা অরুণ শ্রীবাস্তব নিশ্চিত করেছেন, অভিযুক্ত চার স্বাস্থ্যকর্মী ফতেহাবাদ কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করছিলেন।
অরুণ সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ‘‘একই রকমের অন্য কোনও ঘটনা ঘটেছে কি না তা নির্ধারণের জন্য একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত চলছে। বিভাগীয় কর্মীরা জড়িত না থাকলে এমন জালিয়াতি ঘটত না।’’
কর্মকর্তাদের মতে, জাল তথ্য এবং ভুয়ো চিকিৎসা রেকর্ডের মাধ্যমে সরকারি প্রকল্পের অপব্যবহারের একটি চক্র অনেক দিন ধরেই সক্রিয়। সরকারের সন্দেহ, চিকিৎসক, প্রশাসনিক কর্মী, নার্সরাও ওই কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন। উল্লেখ্য, ঘটনাটি জনস্বাস্থ্য প্রকল্পগুলিতে তদারকির অভাব, জাল পরিচয়পত্র এবং জাল রেকর্ডের মাধ্যমে সরকারি সুবিধার অপব্যবহারের নিয়ে একাধিক প্রশ্ন তুলেছে।
সূত্র: আনন্দবাজার